আজ মঙ্গলবার, ১২ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মজিদের ক্ষমতার রহস্য কী?

সংবাদচর্চা রিপোর্ট:

মহানগর বিএনপির উপদেষ্টা, ১ নং বাবুরাইল এলাকার ব্যাপক ক্ষমতাধর ব্যক্তি আব্দুল মজিদের ক্ষমতার রহস্য জানতে ব্যাকুল নারায়ণগঞ্জবাসী। ক্ষমতার ব্যবহার করে তিনি জিমখানা সড়কে সিএনজি স্ট্যান্ড, অটো স্ট্যান্ড পরিচালনা করছেন। তাছাড়া আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ব্যাপক আলোচিত কাশিপুর খুনের মামলা তদন্তে তার সম্পৃক্ততাও পেয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ। তিনি বিএনপির শহর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হাসানের বড় ভাই ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র আফসানা আফরোজ বিভার ভাসুর।

জানা গেছে, এক বছর আগে ফতুল্লার কাশীপুরের হোসাইনি নগর এলাকাতে জোড়া খুনের ঘটনায় রিমান্ডে থাকা আসামী রাকিব চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রদান করে। রিমান্ডে নেওয়ার পর ডিবি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। আসামীদেরকে চার দিনের রিমান্ডে টানা হয়। এছাড়া বুধবার গ্রেপ্তার করা হয় এজাহারভুক্ত আসামী আবুল হোসেনকে। তার আগে গ্রেপ্তার হয় রাজন। মামলাটি ডিবি তদন্ত করে। ডিবির পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করে। এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশীট) দেয়া হয় নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিবির একটি সূত্র জানান, মূলত এলাকাতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটানো হয়। হত্যার ঘটনায় বেশ কয়েকজনের নাম উঠে আসে যারা এজাহারভুক্ত আসামী না। তাদের ব্যাপারে যাচাই বাছাই চলে। রাকিবের দেওয়া তথ্য মতে এসব আরো যাচাই বাছাই করা হয়। তবে যাদের নাম এসেছে তারা সকলেই রাঘববোয়াল। তাদের অনেককেই নজরদারীতে রাখা হয়। হত্যাকান্ডে যারা ইন্ধন যুগিয়েছে তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতা বলে সূত্র জানায়। এলাকায় ভূমি দখল, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সাথে হত্যাকারীরা ও তাদের গডফাদাররা যে জড়িত এটা পুলিশ অনেকটা নিশ্চিত। শুধু তাই নয় পিছনের ইন্ধনদাতাদেরও পুলিশ চিহ্নিত করে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরেই বাবুরাইল, তাতীপাড়া, হোসাইনিনগর এলাকাতে মাদক ব্যবসা ও জমি ব্যবসার জন্য একটি বিশাল বাহিনী তৈরি করে বিএনপি নেতা এম এ মজিদ ও হাসান আহমেদ। তবে সম্প্রতি ওই ঘটনায় বিরোধ সৃষ্টি হয়। মিল্টন এক সময়ে শহরের বিএনপি নেতা ভ্রাতৃদ্বয় এম এ মজিদ ও তার ছোট ভাই হাসান আহমেদের ক্যাডার থাকলেও কয়েক মাস ধরে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিরোধ জড়িয়ে পড়ে। মূলত এলাকাতে একচ্ছত্র মাদক ব্যবসা ও এলাকা নিয়ন্ত্রন নিয়েই ওই বিরোধের সৃষ্টি। আর সে কারণেই বাপ্পী সিকদার ও জাহাঙ্গীর বেপারীর সঙ্গে বিরোধে জড়ায় মিল্টন। তবে আওয়ামী লীগের কারা এর সাথে জড়িত পুলিশ তা এখনও বলতে নারাজ। সূত্রমতে, খুব দ্রæত এ মামলার চার্জশীট দাখিল করা হবে।

মামলার বাদী ফতুল্লা মডেল থানার এস আই মোজাহারুল ইসলাম উল্লেখ করেন, কাশীপুর হোসাইনিনগর এলাকাতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রন, সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রন করে ভূমিদস্যু জাহাঙ্গীর বেপারী। তার গ্রæপের লোক ছিল মিল্টন ও পারভেজ। এর মধ্যে আধিপত্য নিয়ে মিল্টন ও জাহাঙ্গীর বেপারী আলাদা হয়ে যায়। তখন এক গ্রæপের নেতৃত্বে ছিল জাহাঙ্গীর বেপারী আর অপর গ্রæপের মিল্টন। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চরম আকারে রূপ নেয়। এর জের ধরে গত ৮ অক্টোবর রাত ১১টায় মিল্টনের নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর বেপারীর গ্রæপের সদস্য বাপ্পীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। ওই ঘটনার জের ধরে ১২ অক্টোবর এক নং বাবুরাইলের শুক্কুর মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া জয়নাল আবেদীনের ছেলে জাহাঙ্গীর বেপারী (৪০), ১নং বাবুরাইল তারা মসজিদ এলাকার কাজল মিয়ার ছেলে বাপ্পী (২৮), রবিন (৩০), রকি (২৮), ভূইয়াপাড়া এলাকার মজনু মিয়ার ছেলে আমান (৩২), বাবুরাইল শেষমাথা এলাকার খোকা মিয়ার ছেলে শহিদ (৩০), বাবুরাইল তারা মসজিদ এলাকার আসলাম (৫০), বাবুরাইল ঋষিপাড়া এলাকার মৃত জাকিরের ছেলে মাহাবুব (৩০), বিএনপি নেতা হাসান আহমেদের চাচাতো ভাই শিপলু (৩০) ও ভাগ্নে রাসেল (৩৩), বাবুরাইল এলাকার মুক্তা (২৮), পাইকপাড়া জিমখানা ডিমের দোকান এলাকার শরীফ (৩৩), বাবুরাইলের রানা (২৮), বাবুরাইলের কিরণ (৩০), মানিক (৩০), বাবুরাইলের আবদুল মান্নানের ছেলে ফয়সাল (২৬), বন্দর এলাকার রাব্বি (৩০), ১নং বাবুরাইলের নিলু সরদারের ছেলে সোহাগ (৩২), বাবুরাইল শেষমাথা এলাকার রাকিব (২৭), বাবুরাইল ঋষিপাড়া এলাকার সিরাজ মিয়ার ছেলে রাজন (৩০), বাবুরাইল এলাকার রিক্সা আবুল (৩৫), একই এলাকার ফরহাদ (৫২) সহ অজ্ঞাত আরো ১শ থেকে ১২৫ জন সন্ত্রাসী রামদা, চাপাতি ও লোহার রড নিয়ে মিল্টনের বাড়িতে হামলা করে। সেখানে বাড়ি ভাঙচুর করে সোয়া ৭টায় রাজিবের মালিকানাধীন রিকশার গ্যারেজে প্রবেশ করে। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা মিল্টন ও পারভেজের উপর হামলা করে তাদেরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে তাদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়।

হোসাইনিনগর এলাকার একাধিক সূত্র জানান, মিল্টন ও বাপ্পী শিকদার সহ জাহাঙ্গীর বেপারীর ‘বস’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন মজিদ ও হাসান। মজিদ মূলত এ বাহিনীকে দিয়ে শহরের নিতাইগঞ্জ, মন্ডলপাড়া ও এর আশপাশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করাতো। আর হাসান তাদেরকে দিয়ে বিভিন্ন জমি দখল ও ভূমিদস্যুতা কাজে লাগাতো। আর এসব কারণে তাদের হাতেও তুলে দেওয়া হয় অস্ত্র। এছাড়া তারা এলাকাতে মাদক ব্যবসার বড় একটি সেক্টর নিয়ন্ত্রন করতো। কিন্তু এলাকাটি ফতুল্লা ও সদরের সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে পুলিশও খুব একটা নজর দিত না। আর পুলিশের মামলাতেও স্পষ্ট লেখা আছে জাহাঙ্গীর বেপারী মাদক ব্যবসা করতো।

স্থানীয় সূত্র জানান, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বরিশাইল্লা ফিরোজের বোন জামাতা হলো জাহাঙ্গীর বেপারী। বিএনপির নেতাদের আশীর্বাদে সে মূলত বিশাল বাহিনী গড়ে তোলে। এ বাহিনীতেই ছিল মিল্টন, বাপ্পী সিকদার সহ অনেকে। তারা আগে একত্রে সব অপকর্ম করলেও কয়েক মাস ধরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর তখন থেকেই শুরু হয় দুই পক্ষের বিরোধ। ১২ অক্টোবর মিল্টনকে কুপিয়ে হত্যার চারদিন আগে বাপ্পীকে মারধর করে জখম করে মিল্টনের লোকজন। এ নিয়ে শালিসী বৈঠকও হয়। সেখানে মজিদ ওই গ্রæপের লোকজনকে বলে, ‘মারতে হলে বরিশাইল্লাদের মাইরা ফালা।’।

মূলত মজিদের ওই ঘোষণার পরেই বাপ্পী সিকদার ও জাহাঙ্গীর বেপারীর লোকজন উত্তেজিত হয়ে উঠে।

নিহতরা হলো তুহিন হাওলাদার মিল্টন (৩৮) ও পারভেজ আহমেদ (৩০)। তাদের মধ্যে মিল্টনের বাড়ি বরিশাল। তার বাবার নাম শাহেব আলী। পারভেজের বাবার নাম মিজানুর রহমান। দুইজনই কাশীপুর হোসাইনি নগর এলাকাতে থাকতো। এ দুইজন সেখানে ‘ছায়াবৃত্ত শ্রমজীবি সমবায় সমিতি লিমিটেড’ চালাতো। মিল্টন ছিল এটার মালিক আর পারভেজ ছিল ম্যানেজার।

আর যারা হামলা করেছে তারা সকলেই হাসান ও মজিদ বাহিনীর লোক। মামলায় যে ২২জনের নাম উল্লেখ আছে তাদের মধ্যে দুইজন হলেন মজিদ ও হাসানের ভাতিজা ভাগ্নে রাসেল ও চাচাতো ভাই শিপলু। তাছাড়া যাদের আসামী করা হয়েছে তাদের সবার সঙ্গেই হাসান ও মজিদের সম্পৃক্ততা আছে। ২২ জনের সবাই হাসান ও মজিদ বাহিনীর ক্যাডার হিসেবেই পরিচিত। আসামীদের বেশীরভাগের বাড়ি বাবুরাইল ও ভূইয়াপাড়া এলাকাতে যে এলাকাগুলো মূলত হাসান ও মজিদ নিয়ন্ত্রন করে থাকে।

এছাড়াও ক্ষমতার দাপটে সিএনজি স্ট্যান্ড, অটো স্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন ধরনের দখল বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন দেদারসে। জিমখানা থেকে কাশীপুর দেওয়ানবাড়ী, খিলমার্কেট, ফকিরবাড়ী, হাটখোলা, দিঘিরচর, মুক্তাপুরসহ মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন সড়কে ২৫০টির অধিক অবৈধ ইজিবাইক চলাচল করে তার নেতৃত্বে। প্রতিটি ইজিবাইক থেকে দৈনিক ১৪০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। তার লোক রুবেলের ছোট ভাই রানা অপরটি জিমখানা এলাকার শাকিল ও খোরশেদ।

শহরের মন্ডল পাড়া সিএনজি স্ট্যান্ডে ২২০ টি সিএনজি প্রতিদিন মুন্সিগঞ্জ রোডে চলাচল করে। এ সকল সিএনজি থেকে প্রতিদিন ১শ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া জিমখানা থেকে মুন্সিগঞ্জের হাটখোলা ফকির বাড়ী কাটপট্টি, মুক্তারপুর সড়কে চলাচলকারী অবৈধ ইজিবাইক থেকে ১৪০ টাকা করে উত্তোলন করে মজিদের আস্থাভাজন নতুন জিমখানা এলাকার শাকিল ও খোরশেদ।